(১) বৃষ্টি প্রার্থনার জন্য :
আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ)-এর যামানায় এক বছর দুর্ভি¶ দেখা দিল। একদা নবী করীম (ছাঃ) খুৎবা প্রদানকালে জনৈক বেদুঈন উঠে দাঁড়াল এবং আরয করল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! বৃষ্টি না হওয়ার কারণে সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, পরিবার-পরিজন অনাহারে মরছে। আপনি আমাদের জন্য দো‘আ করুন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) স্বীয় হস্তদ্বয় উত্তোলন পূর্বক দো‘আ করলেন। সে সময় আকাশে কোন মেঘ ছিল না। (রাবী বলেন,) আল্লাহর কসম করে বলছি, তিনি হাত না নামাতেই পাহাড়ের মত মেঘের খন্ড এসে একত্র হয়ে গেল এবং তাঁর মিম্বর থেকে নামার সাথে সাথেই ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছিল। আমাদের ওখানে সেদিন বৃষ্টি হ’ল। তারপর ক্রমাগত পরবর্তী জুম‘আ পর্যন্ত বৃষ্টি হ’তে থাকল। অতঃপর পরবর্তী জুম‘আর দিনে সে বেদুঈন অথবা অন্য কেউ উঠে দাঁড়াল এবং বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! অতি বৃষ্টিতে আমাদের বাড়ী-ঘর ভেঙ্গে পড়ে যাচ্ছে, ফসল ডুবে যাচ্ছে। অতএব আপনি আল্লাহর নিকট আমাদের জন্য দো‘আ করুন। তখন তিনি দু’হাত তুললেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমাদের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বৃষ্টি দাও, আমাদের এখানে নয়। এ সময়ে তিনি স্বীয় অঙ্গুলি দ্বারা মেঘের দিকে ইশারা করেছিলেন। ফলে সেখান থেকে মেঘ কেটে যাচ্ছিল’ (বুখারী, ১ম খন্ড, পৃঃ ১২৭)।
(২) আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা জুম‘আর দিন জনৈক বেদুঈন আরবী রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! (বৃষ্টির অভাবে) গৃহপালিত পশুগুলি মারা যাচ্ছে। মানুষ খতম হয়ে যাচ্ছে। তখন রাসূল (ছাঃ) দো‘আর জন্য দু’হাত উঠালেন। আর লোকেরাও রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে হাত উঠাল। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা মসজিদ থেকে বের হওয়ার পূর্বেই বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেল। এমনকি পরবর্তী জুম‘আ পর্যন্ত বৃষ্টি বর্ষিত হ’তে থাকল। তখন একটি লোক রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)!
(৩) আনাস (রাঃ) বলেন, কোন এক জুম‘আয় কোন এক ব্যক্তি দার“ল কোযার দিক হ’তে মসজিদে প্রবেশ করল, এমতাবস্থায় যে, রাসূল (ছাঃ) তখন খুৎবা দিচ্ছিলেন। লোকটি রাসুলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাৎ)! সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেল এবং রাস্তা ঘাট বন্ধ হয়ে গেল। আপনি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করুন, আল্লাহ আমাদেরকে বৃষ্টি দান করবেন। আনাস (রাঃ) বলেন, তখন রাসুলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় হস্তদ্বয় উত্তোলন করত প্রার্থনা করলেন, ‘হে আল্লাহ! আমাদের বৃষ্টি দান করুন! হে আল্লাহ! আমাদের বৃষ্টি দান করুন!’ (বুখারী, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৩৭; মুসলিম, ১ম খন্ড, পৃঃ ২৯৩-২৯৪)।
(৪) আনাস (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে হস্তদ্বয়ের পিঠ আকাশের দিকে করে পানি চাইতে দেখেছি (মুসলিম, মিশকাত হা/১৪৯৮ ‘ইস্তিস্কাঅনুচ্ছেদ)।
(৫) আনাস (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বৃষ্টি প্রার্থনা ব্যতীত অন্য কোথাও হাত তুলতেন না। আর হাত এত পরিমাণ উঠাতেন যে, তার বগলের শুভ্র অংশ দেখা যেত (বুখারী ১/১৪০ পৃঃ, হা/১০৩১; মিশকাত হা/১৪৯৯)। প্রকাশ থাকে যে, হাত তুলে দো‘আ করার অনেক হাদীছ আছে, তবে পানি চাওয়ার জন্য যেভাবে তোলা হয় সেভাবে নয়।
(৬) বৃষ্টি বন্ধের জন্য :
আনাস (রাঃ) বলেন, পরবর্তী জুম‘আয় ঐ দরজা দিয়েই জনৈক ব্যক্তি প্রবেশ করল রাসূল (ছাঃ)-এর দাঁড়িয়ে খুৎবা দান রত অবস্থায়। অতঃপর লোকটি রাসূল (ছাঃ)- এর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেল এবং রাস্তা-ঘাট বন্ধ হয়ে গেল। আপনি আল্লাহর নিকট দো‘আ করুন, আল্লাহ বৃষ্টি বন্ধ করে দিবেন। রাবী আনাস (রাঃ) বলেন, তখন রাসূল (ছাঃ) স্বীয় হস্তদ্বয় উত্তোলন পূর্বক বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমাদের নিকট থেকে বৃষ্টি সরিয়ে নিন, আমাদের পার্শ্ববর্তী এলাকায় দিন, আমাদের উপর নয়। হে আল্লাহ! অনাবাদী জমিতে, উচু জমিতে, উপত্যকায় এবং ঘন বৃক্ষের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করুন’ (বুখারী, ১ম খন্ড, ১৩৭ পৃঃ; মুসলিম, ১ম খন্ড, পৃঃ ২৯৩-২৯৪)।
(৭) চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের সময় :
আব্দুর রহমান ইবনু সামুরাহ (রাঃ) বলেন, একদা আমি রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় তীর নিরোপ করছিলাম। হঠাৎ দেখি সূর্যগ্রহণ লেগেছে। আমি তীরগুলি নিরোপ করলাম এবং বললাম, আজ সূর্যগ্রহণে রাসূল (ছাঃ)-এর অবস্থান লক্ষ্য করব। অতঃপর আমি তাঁর নিকট পৌঁছলাম। তিনি তখন দু’হাত উঠিয়ে প্রার্থনা করছিলেন এবং তিনি আল্লাহু আকবার, আল-হামদুলিল্লাহ, লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ বলছিলেন। শেষ পর্যন্ত সূর্য প্রকাশ হয়ে গেল। অতঃপর তিনি দু’টি সূরা পড়লেন এবং দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করলেন’ (মুসলিম, ১ম খন্ড, পৃঃ ২৯৯)। (৮) উম্মতের জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর দো‘আ :
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনে আছ (রাঃ) বলেন, একদা রাসূল (ছাঃ) সূরা ইবরাহীমের ৩৫নং আয়াত পাঠ করে দু’হাত উঠিয়ে বলেন, আমার উম্মত, আমার উম্মত এবং কাঁদতে থাকেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, হে জিবরীল! তুমি মুহাম্মাদের নিকট যাও এবং জিজ্ঞেস কর, কেন তিনি কাঁদেন। অতঃপর জিবরীল তার নিকটে আগমন করে কাঁদার কারণ জানতে চাইলেন। তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে কাঁদার কারণ বললেন, যা আল্লাহ তা‘আলা অবগত। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা জিবরীলকে বললেন, যাও, মুহাম্মাদকে বল যে, আমি তার উপর এবং তার উম্মতের উপর সন্তুষ্ট আছি। আমি তার কোন অকল্যাণ করব না’ (মুসলিম, ১ম খন্ড, পৃঃ ১১৩)। (৯) কবর যিয়ারতের সময় :
আয়েশা (রাঃ) বলেন, একদা রাতে রাসূল (ছাঃ) আমার নিকটে ছিলেন। রাতে শোয়ার সময় চাদর রাখলেন এবং জুতা খুলে পায়ের নীচে রেখে শুয়ে পড়লেন। তিনি অল্প সময় এ খেয়ালে থাকলেন যে, আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। অতঃপর ধীরে চাদর ও জুতা নিলেন এবং ধীরে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লেন এবং দরজা বন্ধ করে দিলেন। তখন আমিও কাপড় পরে চাদর মাথায় দিয়ে তাঁর পিছনে চললাম। তিনি ‘বাক্বীউল গারক্বাদে’ (জান্নাতুল বাক্বী) পৌঁছলেন এবং দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকলেন। অতঃপর তিনবার হাত উঠিয়ে প্রার্থনা করলেন’ (মুসলিম, ১ম খন্ড, পৃঃ ৩১৩)।
আয়েশা (রাঃ) বলেন, কোন এক রাতে রাসূল (ছাঃ) বের হ’লেন, আমি বারিরা (রাঃ)-কে পাঠালাম, তাঁকে দেখার জন্য যে, তিনি কোথায় যান। তিনি বাকীউল গারক্বাদে গেলেন এবং পার্শ্বে দাঁড়ালেন। অতঃপর হাত তুলে দো‘আ করলেন। তারপর ফিরে আসলেন। বারিরাও ফিরে আসলো এবং আমাকে খবর দিল। আমি সকালে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি গত রাতে কোথায় গিয়েছিলেন? তিনি বললেন, বাক্বীউল গারক্বাদে গিয়েছিলাম, কবর বাসীর জন্য দো‘আ করতে (ইমাম বুখারী, রাফ‘ঊল ইয়াদায়েন, পৃঃ ১৭, হাদীছ ছহীহ)। (১১) কারো জন্য ক্ষমা চাওয়ার ল¶্যে হাত তুলে দো‘আ :
আউতাসের যুদ্ধে আবু আমেরকে তীর লাগলে আবু আমের স্বীয় ভাতিজা আবু মূসার মাধ্যমে বলে পাঠান যে, আপনি আমার প¶ থেকে রাসূল (ছাঃ)-কে সালাম পৌঁছে দিবেন এবং ক্ষমা চাইতে বলবেন। আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) পানি নিয়ে ডাকলেন এবং ওযূ করলেন। অতঃপর হাত তুলে প্রার্থনা করলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহ! উবাইদ ও আবু আমেরকে ক্ষমা করে দাও। (রাবী বলেন) এসময়ে আমি তাঁর বগলের শুভ্রতা দেখলাম। তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহ! ক্বিয়ামতের দিন তুমি তাকে তোমার সৃষ্টি মানুষের অনেকের ঊর্ধ্বে করে দিও’ (বুখারী, ২য় খন্ড, পৃঃ ৯৪৪)। (১২) হজ্জে পাথর নিক্ষেপের সময় :
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) নিকটবর্তী জামারায় সাতটি করে পাথর খন্ড নিরোপ করতেন এবং প্রতিটি পাথর নিক্ষেপের সাথে তাকবীর বলতেন। তারপর তিনি অগ্রসর হয়ে নরম ভূমিতে নামতেন এবং ক্বিবলামুখী হয়ে দীর্ঘ¶ণ দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে দো‘আ করতেন। শেষে বলতেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে এভাবেই করতে দেখেছি’ (বুখারী, ১ম খন্ড পৃঃ ২৩৬)। (১৩) যুদ্ধক্ষেত্রে:
ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বদরের যুদ্ধে মুশরিকদের দিকে লক্ষ্য করে দেখলেন, তাদের সংখ্যা এক হাযার। আর তাঁর সাথীদের সংখ্যা মাত্র তিনশত তের জন। তখন তিনি ক্বিবলামুখী হয়ে দু’হাত উঠিয়ে দো‘আ করতে লাগলেন। এ সময়ে তিনি বলছিলেন, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে সাহায্য করার ওয়া‘দা করেছ। হে আল্লাহ! তুমি যদি এই জামা‘আতকে আজ ধ্বংস করে দাও, তাহ’লে এই যমীনে তোমাকে ডাকার মত আর কেউ অবশিষ্ট থাকবে না। এভাবে তিনি উভয় হাত তুলে ক্বিবলামুখী হয়ে প্রার্থনা করতে থাকলেন। এ সময় তাঁর কাঁধ হ’তে চাদরখানা পড়ে গেল। আবু বকর (রাঃ) তখন চাদরখানা কাঁধে তুলে দিয়ে রাসূল (ছাঃ)-কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনার প্রতিপালক প্রার্থনা কবুলে যথেষ্ট, নিশ্চয়ই তিনি আপনার সাথে কৃত ওয়াদা পূরণ করবেন’ (মুসলিম, ২য় খন্ড, পৃঃ ৯৩, হা/১৭৬৩, ‘জিহাদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৮)।
(১৪) কোন গোত্রের জন্য দো‘আ করা :
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, একদা আবু তুফাইল রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে গিয়ে বলল, হে আল্লাহর রসূল (ছাঃ)! দাঊস গোত্র অবাধ্য ও অবশীভ‚ত হয়ে গেছে, আপনি তাদের জন্য আল্লাহর কাছে বদ দো’আ করুন। তখন রাসূল (ছাঃ) ক্বিবলামুখী হ’লেন এবং দু’হাত তুলে বললেন, হে আল্লাহ! তুমি দাওস গোত্রকে হেদায়াত দান কর এবং তাদেরকে সঠিক পথে নিয়ে আস। অথচ মানুষেরা মনে করেছিল যে, তিনি তাদের বির“দ্ধে বদ দো‘আ করেছেন’ (বুখারী, মুসলিম, ছাহীহ আলআদাবুল মুফরাদ, ২য় খন্ড, পৃঃ ৭০, সনদ ছহীহ)। (১৫) বায়তুল্লাহ দেখে :
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রসূল (ছাঃ) মক্কায় প্রবেশ করলেন এবং পাথরের নিকট এসে পাথর চুম্বন করলেন। অতঃপর বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করলেন এবং ছাফা পাহাড়ে এসে তার উপর উঠলেন। অতঃপর তিনি বায়তুল্লাহর প্রতি লক্ষ্য করলেন এবং দু’হাত উত্তোলন পূর্বক আল্লাহকে ইচ্ছামত স্মরণ করতে লাগলেন এবং প্রার্থনা করতে লাগলেন (আবুদাঊদ, হা/১৮৭১ সনদ ছহীহ)। (১৬) কুনূতে নাযেলার সময় : আবু ওসামা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) কুনূতে নাযেলায় হাত তুলে দো‘আ করেছিলেন (ইমাম বুখারী, রাফ‘ঊল ইয়াদায়েন, সনদ ছহীহ)।
(১৭) খালিদ (রাঃ)-এর অপসন্দনীয় কর্মের কারণে হাত তুলে দো‘আ :
সালেমের পিতা বলেন, নবী করীম (ছাঃ) খালেদ ইবনু ওয়ালীদকে বনী জুযাইমার বির“দ্ধে এক অভিযানে পাঠালেন। খালেদ তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তারা এ দাওয়াত গ্রহণ করে নিল। কিন্তু ‘ইসলাম গ্রহণ করেছি’ না বলে তারা বলতে লাগল, ‘আমরা নিজেদের ধর্ম ত্যাগ করেছি’ ‘আমরা নিজেদের ধর্ম ত্যাগ করেছি’। কিন্তু খালেদ তাদেরকে কতল ও বন্দী করতে লাগলেন। আর বন্দীদেরকে আমাদের প্রত্যেকের হাতে সমর্পণ করতে থাকলেন। একদিন খালেদ আমাদের প্রত্যেকে স্ব স্ব বন্দী হত্যা করার নির্দেশ দিলেন। আমি বললাম, আল্লাহর কসম! আমি নিজের বন্দীকে হত্যা করব না এবং আমার সাথীদের কেউই তার বন্দীকে হত্যা করবে না। অবশেষে আমরা নবী করীম (ছাঃ)-এর খেদমতে হাযির হ’লাম। তাঁর কাছে উক্ত ঘটনা বর্ণনা করলাম। তখন নবী করীম (ছাঃ) স্বীয় হ¯— উত্তোলন পূর্বক প্রার্থনা করলেন, ‘হে আল্লাহ! খালেদ যা করেছে তার দায় থেকে আমি মুক্ত। এ কথা তিনি দু’বার বললেন’ (বুখারী, ২য় খন্ড, পৃঃ ৬২২)। (১৮) ছাদাক্বা আদায়কারীর ভুল মন্তব্য শুনে হাত তুলে দো‘আ : আবু হুমায়েদ সায়েদী (রাঃ) বলেন, একবার নবী করীম (ছাঃ) ইবনু লুত্ববিইয়াহ নামক ‘আসাদ’ গোত্রের জনৈক ব্যক্তিতে যাকাত আদায়ের জন্য কর্মচারী নিযুক্ত করলেন। তখন সে যাকাত নিয়ে মদীনায় ফিরে এসে বলল, এই অংশ আপনাদের প্রাপ্য যাকাত, আর এই অংশ আমাকে হাদিয়া স্বরূপ দেওয়া হয়েছে। এ কথা শুনে নবী করীম (ছাঃ) ভাষণ দানের জন্য দাঁড়ালেন এবং প্রথমে আল্লাহর গুণগান বর্ণনা করলেন। অতঃপর বললেন, আমি তোমাদের কোন ব্যক্তিকে সে সকল কাজের কোন একটির জন্য কর্মচারী নিযুক্ত করি, যে সকল কাজের দায়িত্ব আল্লাহ তা‘আলা আমার উপর সমর্পণ করেছেন। অতঃপর তোমাদের সে ব্যক্তি এসে বলে যে, এটা আপনাদের প্রাপ্য যাকাত, আর এটা আমাকে হাদিয়া স্বরূপ দেওয়া হয়েছে। সে কেন তার পিতা-মাতার ঘরে বসে থাকল না? দেখা যেত কে তাকে হাদিয়া দিয়ে যায়? আল্লাহর কসম! যে ব্যক্তি এর কোন কিছু গ্রহণ করবে, সে নিশ্চয়ই ক্বিয়ামতের দিন তা আপন ঘাড়ে বহন করে হাযির হবে। যদি আত্মসাৎকৃত বস্তু উট হয়, উটের ন্যায় ‘চি চি’ করবে। যদি গর“ হয়, তবে ‘হাম্বা হাম্বা’ করবে। আর যদি ছাগল-ভেড়া হয়, তবে ‘ম্যা ম্যা’ করবে। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) স্বীয় হস্তদ্বয় উঠালেন, যাতে আমরা তাঁর বগলের শুভ্রতা প্রত্য¶ করলাম। তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহ ! নিশ্চয়ই তোমার নির্দেশ পৌঁছে দিলাম। হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমি পৌঁছে দিলাম’ (বুখারী, ১ম খন্ড, পৃঃ ২৫৩; ঐ, ২য় খন্ড, পৃঃ ৯৮২, ১০৬৪)।
(১৯) মুসাফির বিপদের সম্মুখীন হয়ে হাত তুলে দো‘আ :
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, একদা রাসূল (ছাঃ) বৈধ খাদ্য সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এক ব্যক্তির দৃষ্টাš— তুলে ধরেন, যে দূর-দূরাš— সফর করে চলেছে। তার মাথার চুল এলোমেলো, শরীরে ধুলাবালি। এমতাবস্থায় ঐ ব্যক্তি দু’হাত আকাশের দিকে উঠিয়ে কাতর কণ্ঠে ‘হে প্রভু’ ‘হে প্রভু’ বলে ডাকে। কিন্তু তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পরণের পোষাক হারাম এবং তার আহারের ব্যবস্থা করা হয় হারাম দ্বারা, তার দো‘আ কি কবুল হ’তে পারে?’ (মুসলিম, মিশকাত, পৃঃ ২৪১)। (২০) ইবরাহীম (আঃ) তাঁর সন্তান ও স্ত্রীকে নির্জন ভূমিতে রেখে যাওয়ার সময় হাত তুলে পঠিত দো‘আ :
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, যখন ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় স্ত্রী ও পুত্রকে রেখে র্ফিরে আসেন এং গিরিপথের বাঁকে এসে পৌঁছেন, যেখান থেকে স্ত্রী ও পুত্র তাঁকে দেখতে পাচ্ছিল না, তখন তিনি কা‘বা ঘরের দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন এবং দু’হাত তুলে দো‘আ করলেন যে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তোমার পবিত্র ঘরের নিকটে এমন এক ময়দানে আমার স্ত্রী ও পুত্রকে রেখে যাচ্ছি, যা শস্যের অনুপযোগী এবং জনশূন্য মর“ভূমি। হে প্রভু! এ উদ্দেশ্যে যে, তারা ছালাত কায়েম করবে। অতএব তুমি লোকদের মনকে এ দিকে আকৃষ্ট করে দাও এবং প্রচুর ফল ফলাদি দ্বারা এদের রিযিকের ব্যবস্থা করে দাও। তারা যেন তোমার শুকরিয়া আদায় করতে পারে’ (বুখারী, ১ম খন্ড, পৃঃ ৪৭৫)।
(২১) মুমিনকে কষ্ট বা গালি দেওয়ার প্রতিকারে হাত তুলে দো‘আ :
আয়েশা (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-কে হাত তুলে দো‘আ করতে দেখেন। তিনি দো‘আয় বলছিলেন, নিশ্চয়ই আমি মানুষ। কোন মুমিনকে গালি বা কষ্ট দিয়ে থাকলে তুমি আমাকে শাস্তি প্রদান কর না’ (আদাবুল মুফরাদ, ২য় খন্ড, পৃঃ ৭০, সনদ ছহীহ)।
হাত তুলে দো‘আ করার অন্যান্য ছহীহ হাদীছ সমূহ
(২২) আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ) দু’হাতের পেটের এবং পিঠের দিকে দো‘আ করতে দেখেছি (আবুদাঊদ, হা/১৪৮, সনদ ছহীহ)।
(২৩) সালমান (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক মঙ্গলময়, উচ্চ লজ্জাশীল। তাঁর বান্দা যখন হাত উঠিয়ে তাঁর নিকট চায়, তখন তিনি খালি হাতে ফেরত দিতে লজ্জাবোধ করেন’ (আবুদাঊদ, হা/১৪৮৮, সনদ ছহীহ)। (২৪) ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, চাওয়ার নিয়ম হচ্ছে- তুমি তোমার দু’হাতকে কাঁধ পর্যন্ত অথবা কাঁধের কাছাকাছি উঠাবে। আর ক্ষমা প্রার্থনার (নিয়ম) হচ্ছে
তুমি তোমার অঙ্গুলি দ্বারা ইশারা করবে। আর বিনীতভাবে চাওয়ার নিয়ম হচ্ছে, তুমি তোমার হাত পূর্ণ প্রসারিত করবে (আবুদাঊদ, হা/১৪৮৯, সনদ ছহীহ)। ,
(২৫) মালেক ইবনু ইয়াসার (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন তোমরা আল্লাহর নিকট চাইবে, তখন তোমাদের হাতের পেটের মাধ্যমে চাইবে, হাতের পিঠের মাধ্যমে চেয়ো না’ (আবুদাঊদ, হা/১৪৮৬, সনদ ছহীহ)।
(২৬) আলী (রাঃ) বলেন, আমি ওয়ালীদের স্ত্রীকে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট আসতে দেখলাম এবং তার স্বামীর ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট অভিযোগ পেশ করতে দেখলাম। তখন রাসূল (ছাঃ) তাঁর হাত উঠালেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহ! ওয়ালীদকে দেখার দায়িত্ব আপনার উপরই রয়েছে’ (ইমাম বুখারী, রাফ‘উল ইয়াদায়েন, পৃঃ ১৭)।
(২৭) ওছমান (রাঃ) বলেন, একবার আমরা এক জায়গায় অবস্থান করছিলাম, আর ওমর (রাঃ) লোকদের ইামামতি করছিলেন। তিনি আমাদের সাথে নিয়ে রুকু‚র সময় তাঁর দু’হাত উঠিয়ে কুনূত করছিলেন, তাঁর দু’হাত ও দু’বগল প্রকাশ হয়ে পড়েছিল (রাফ‘উল ইয়াদায়েন, পৃঃ ১৮, হাদীছ ছহীহ)।
(২৮) আমর ইবনু দীনার বলেন যে, তিনি তাউস (রাঃ)-কে বলতে শুনেছেন, রাসূল (ছাঃ) একদা এক স¤প্রদায়ের উপর বদ দো‘আ করার সময় হাত তুলে দো‘আ করলেন। আমর ইবনু দীনার আকাশের দিকে হাত বেশী উঠিয়ে আমাকে দেখালেন, ফলে উটটি লাফালাফি করতে লাগল। তখন তিনি এক হাত দিয়ে তার উটনি ধরলেন এবং অপর হাত আকাশের দিকে উঠিয়ে রাখলেন’ (মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৪৭, সনদ ছহীহ)।
(২৯) খালিদ ইবনু ওয়ালীদ (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট তার বাড়ীর সংকীর্ণতার অভিযোগ করলেন, তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তুমি তোমার দু’হাত আকাশের দিকে উঠাও এবং আল্লাহর নিকট প্রশস্ততা চাও’ (মাজমাউয যাওয়ায়েদ, ১০ম খন্ড, পৃঃ ১৬৯)।
(৩০) আয়েশা (রাঃ) বলেন, একদা আমি রাসূল (ছাঃ)-কে তাঁর দু’হাত তুলে ওছমান (রাঃ)-এর জন্য দো‘আ করতে দেখলাম (ফাৎহুল বারী, ১১শ খন্ড, ১৪২ পৃঃ; রাফ‘উল ইয়াদায়েন)।
(৩১) আবু হুরায়রা (রাঃ) মক্কা বিজয়ের লম্বা হাদীছ বর্ণনা করেন এবং বলেন, রাসূল (ছাঃ) তাঁর দু’হাত উঠালেন এবং দো‘আ করতে লাগলেন (ফাৎহুল বারী, ১১ খন্ড, পৃঃ ১৪২, ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ অধ্যায়, সনদ ছহীহ)।
(৩২) আত্বা (রাঃ) বলেন, ওসামা ইবনু যায়েদ (রাঃ) বলেছেন, আমি আরাফার মাঠে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে একই আরোহীতে ছিলাম। রাসূল (ছাঃ) তাঁর দু’হাত তুলে দো‘আ করলেন, তখন উটনী রাসূল (ছাঃ)-কে নিয়ে একদিকে সরে গেল এবং উটনীর লাগাম হাত থেকে পড়ে গেল। রাসূল (ছাঃ) তাঁর এক হাত দ্বারা লাগাম ধরে থাকলেন এবং অপর হাত উঠিয়ে রাখলেন (ছহীহ নাসাঈ, হা/৩০১১)।
(৩৩) ক্বায়েস ইবনু সা‘আদ বর্ণনা করেন যে, রাসূল (ছাঃ) তাঁর দু’হাত উঠালেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহ! আপনার দয়া ও রহমত সা‘আদ ইবনু ওবাদার পরিবারের উপর অবতীর্ণ হৌক’ (আবুদাঊদ, ফাৎহুল বারী, ১১শ খন্ড, পৃঃ ১৪২, হাদীছ ছহীহ)। সম্মানিত পাঠকগণ! আলোচ্য অধ্যায়ে হাত তুলে দো‘আ করার প্রমাণে ছহীহ-যঈফ মিলে সর্বমোট ৪৭টি হাদীছ পেশ করা হ’ল, যা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হাত তুলে দো‘আ করার বিধান শরী‘আতে রয়েছে। তবে এ দো‘আ করতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিয়ম-পদ্ধতির এক চুলও ব্যতিক্রম করা যাবে না। কেননা দো‘আও ইবাদতেরই অংশ বিশেষ। অতএব দো‘আর ¶েত্র ও পদ্ধতি ঠিক রেখে হাত তুলে দো‘আ করা যাবে। অন্যথা এর ব্যতিক্রম ঘটলে বিদ‘আতে পরিণত হবে (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২৭)। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী আমল করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!!
0 Comments: