(১) আহমাদ ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ)-কে ফরয ছালাতের পর ইমাম-মুক্তাদী সম্মিলিতভাবে দো‘আ করা জায়েয কি-না জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন,
‘ছালাতের পর ইমাম-মুক্তাদী সম্মিলিতভাবে দো‘আ করা বিদ‘আত। রাসুলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে এরূপ দো‘আ ছিল না। বরং তাঁর দো‘আ ছিল ছালাতের মধ্যে। কারণ (ছালাতের মধ্যে) মুছল্লী স্বীয় প্রতিপালকের সাথে নীরবে কথা বলে। আর নীরবে কথা বলার সময় দো‘আ করা যথাযথ’ (মাজমূ‘আ ফাতাওয়া ২২/৫১৯ পৃঃ)। (২) শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রহঃ) বলেন,
‘পাঁচ ওয়াক্ত ফরয ছালাত ও নফল ছালাতের পর দলবদ্ধভাবে দো‘আ করা স্পষ্ট বিদ‘আত। কারণ এরূপ দো‘আ রাসুলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে এবং তাঁর ছাহাবীদের যুগে ছিল না। যে ব্যক্তি ফরয ছালাতের পর অথবা নফল ছালাতের পর দলবদ্ধভাবে দো‘আ করে, সে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বিরোধিতা করে’ (হাইয়াতু কিবারিল ওলামা ১/২৪৪ পৃঃ)।
‘ইমাম-মুক্তাদী সম্মিলিতভাবে দো‘আ করার প্রমাণে রাসুলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে, কথা, কর্ম ও অনুমোদনগত (কাওলী, ফে‘লী ও তাক্বরীরী) কোন হাদীছ সম্পর্কে আমরা অবগত নই। আর একমাত্র রাসুলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আদর্শের অনুসরণেই রয়েছে সমস্ত কল্যাণ। ছালাত আদায়ের পর ইমাম-মুক্তাদীর দো‘আ স¤পর্কে রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শ সুস্পষ্ট আছে, যা তিনি সালামের পর পালন করতেন। চার খলীফাসহ ছাহাবীগণ এবং তাবেঈগণ যথাযথভাবে তাঁর আদর্শ অনুসরণ করেছেন। অতঃপর যে ব্যক্তি তাঁর আদর্শের বিরোধিতা করবে, তাঁর আমল পরিত্যাজ্য হবে। রাসুলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার নির্দেশ ব্যতীত কোন আমল করবে তা পরিত্যাজ্য। কাজেই যে ইমাম হাত তুলে দো‘আ করবেন এবং মুক্তাদীগণ হাত তুলে আমীন আমীন বলবেন তাদের নিকটে এ সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য দলীল চাওয়া হবে। অন্যথা (তারা দলীল দেখাতে ব্যর্থ হ’লে) তা পরিত্যাজ্য’ (হাইয়াতু কিবারিল ওলামা ১/২৫৭ পৃঃ)। আমার জানা মতে, ফরয ছালাতের পর হাত তুলে দো‘আ করা না রাসূল (ছাঃ) থেকে প্রমাণিত, না ছাহাবায়ে কেরাম থেকে প্রমাণিত। ফরয ছালাতের পর যারা হাত তুলে দো‘আ করে, তাদের এ কাজ সুস্পষ্ট বিদ‘আত। এর কোন ভিত্তি নেই। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আমার এ দ্বীনে কেউ নতুন কিছু আবিষ্কার করলে, তা পরিত্যাজ্য’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, পৃঃ ২৭)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, কেউ যদি কোন আমল করে আর তাতে আমার কোন নির্দেশ না থাকে, তবে তা পরিত্যাজ্য’ (বুখারী, পৃঃ ১০৯২; হাইয়াতু কিবারিল ওলামা, পৃঃ ৩৩৭)।
(৩) বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ আলেম আল্লামা নাছের“দ্দীন আলবানী (রহঃ) বলেন, দো‘আয়ে কুনূতে হাত তোলার পর মুখে হাত মোছা বিদ‘আত। ছালাতের পরেও ঠিক নয়। এ সম্পর্কে যত হাদীছ রয়েছে, এর সবগুলিই যঈফ। আমি এ বিষয়ে বি¯— ারিত আলোচনা করেছি যঈফ আবুদাঊদে। এজন্য ইমাম আযদুদ্দীন বলেন, ছালাতের পর হাত তুলে দো‘আ করা মূর্খদের কাজ (ছিফাতু ছালাতিন নবী (ছাঃ), পৃঃ ১৪১)।
(৪) শায়খ ওছায়মীন (রহঃ) বলেন, ছালাতের পর দলবদ্ধভাবে দো‘আ করা এমন বিদ‘আত, যার প্রমাণ রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণ থেকে নেই। মুছল্লীদের জন্য বিধান হচ্ছে প্রত্যেক মানুষ ব্যক্তিগতভাবে যিকির করবে (ফাতাওয়া ওছায়মীন, পৃঃ ১২০)।
(৫) আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি (রহঃ) বলেন, ফরয ছালাতের পর হাত তুলে দো‘আ করা ব্যতীত অনেক দো‘আই রয়েছে (উরফুস সাযী, পৃঃ ৯৫)।
(৬) আল্লামা আব্দুল হাই লক্ষেনীভী (রহঃ) বলেন, বর্তমান সমাজে প্রচলিত যে প্রথা, ইমাম সালাম ফিরানোর পর হাত উঠিয়ে দো‘আ করেন এবং মুক্তাদীগণ আমীন আমীন বলে, এ প্রথা রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে ছিল না (ফৎওয়ায়ে আব্দুল হাই, ১ম খন্ড, পৃঃ ১০০)। (৭) আল্লামা ইউসুফ বিন নূরী বলেন, অনেক স্থানেই এ প্রথা চালু হয়ে গেছে যে, ফরয ছালাতের সালাম ফিরানোর পর সম্মিলিত ভাবে হাত উঠিয়ে মুনাজাত করা, যা রাসূল (ছাঃ) হ’তে প্রমাণিত নয় (মা‘আরেফুস সুনান, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৪০৭)।
(৮) আল্লামা আবুল কাসেম নানুতুবী (রহঃ) বলেন, ফরয ছালাতে সালাম ফিরানোর পর ইমাম-মুক্তাদী সম্মিলিত ভাবে মুনাজাত করা নিকৃষ্টতম বিদ‘আত (এমাদুদ্দীন, পৃঃ ৩৯৭)।
(৯) আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) (৬৯১-৮৫৬হিঃ) বলেন, নিঃসন্দেহ এ প্রথা অর্থাৎ ইমাম সালাম ফিরিয়ে পশ্চিম মুখী হয়ে অথবা মুক্তাদীগণের দিকে ফিরে মুক্তাদীগণকে নিয়ে মুনাজাত করা কখনও রাসূল (ছাঃ)-এর তরীকা নয়। এ সম্পর্কে একটিও ছহীহ অথবা দুর্বল হাদীছও নেই (যাদুল মা‘আদ, ১ম খন্ড, পৃঃ ৬৬)।
(১০) আল্লামা মাজদুদ্দীন ফিরোযাবাদী (রহঃ) বলেন, ফরয ছালাতের সালাম ফিরানোর পর ইমামগণ যে সম্মিলিত মুনাজাত করেন, তা কখনও রাসূল (ছাঃ) করেননি এবং এ সম্পর্কে কোন হাদীছ পাওয়া যায়নি (ছিফর“স সা‘আদাত, পৃঃ ২০)।
(১১) আল্লামা শাত্বেবী (রহঃ) (৭০০ খ্রীঃ) বলেন, শেষ কথা হ’ল এই যে, ফরয ছালাতের পর সর্বদা সম্মিলিতভাবে মুনাজাত রাসূল (ছাঃ) নিজেও করেননি, করার আদেশও দেননি। এমনকি তিনি এটা সমর্থন করেছেন, এধরনেরও কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না (আল-ই‘তেছাম, ১ম খন্ড, পৃঃ ৩৫২)।
(১২) আল্লামা ইবনুল হাজ মাক্কী বলেন, এ কথা নিঃসন্দেহে যে, রাসূল (ছাঃ) ফরয ছালাতের সালাম ফিরানোর পর হাত উঠিয়ে দো‘আ করেছেন এবং মুক্তাদীগণ আমীন আমীন বলেছেন, এরূপ কখনো দেখা যায়নি। চার খলীফা থেকেও এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই এ ধরনের কাজ, যা রাসূল (ছাঃ) করেননি, তাঁর ছাহাবীগণ করেননি, নিঃসন্দেহ তা না করাই উত্তম এবং করা বিদ‘আত (মাদখাল, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৮৩)। (১৩) আল্লামা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) বলেন, ফরয ছালাতের পর ইমাম ছাহেব দো‘আ করবেন এবং মুক্তাদীগণ আমীন আমীন বলবেন, এ সম্পর্কে ইমাম আরফাহ এবং ইমাম গাবরহিনী বলেন, এ দো‘আকে ছালাতের সুন্নাত অথবা মুস্তাহাব মনে করা না জায়েয (এস্তেহবাবুদ দাওয়াহ, পৃঃ ৮)।
(১৪) আল্লামা মুফতী মোহাম্মদ শফী (রহঃ) বলেন, বর্তমানে অনেক মসজিদের ইমামদের অভ্যাস হয়ে গেছে যে, কিছু আরবী দো‘আ মুখস্থ করে নিয়ে ছালাত শেষ করেই (দু’হাত উঠিয়ে) ঐ মুখস্থ দো‘আগুলি পড়েন। কিন্তু যাচাই করে দেখলে দেখা যাবে যে, এ দো‘আগুলির সারমর্ম তাদের অনেকেই বলতে পারে না। আর ইমামগণ বলতে পারলেও এটা নিশ্চিত যে, অনেক মুক্তাদী এ সমস্ত দো‘আর অর্থ মোটেই বুঝে না। কিন্তু না জেনে, না বুঝে আমীন, আমীন বলতে থাকে। এ সমস্ত তামাশার সারমর্ম হচ্ছে কিছু শব্দ পাঠ করা মাত্র। প্রার্থনার যে রূপ বা প্রকৃতি, তা পাওয়া যায় না (মা‘আরেফুল কুরআন, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৫৭৭)। তিনি আরো বলেন, রাসূল (ছাঃ) এবং ছাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেঈনে এযাম হ’তে এবং শরী‘আতের চার মাযহাবের ইমামগণ হ’তে ছালাতের পরে এ ধরনের মুনাজাতের প্রমাণ পাওয়া যায় না। সার কথা হ’ল এ প্রথা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের প্রদর্শিত পন্থা এবং রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের সুন্নাতের পরিপন্থী (আহকামে দো‘আ, পৃঃ ১৩)।
(১৫) মুফতী আযম ফয়যুল্লাহ হাটহাজারী বলেন, ফরয ছালাতের পর দো‘আর চারটি নিয়ম আছে।
(১) মাঝে মাঝে একা একা হাত উঠানো ব্যতীত হাদীছের উলে−খিত মাসনূন দো‘আ সমূহ পড়া। নিঃসন্দেহে এটা ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত।
(২) মাঝে মাঝে একা একা হাত উঠিয়ে দো‘আ করা। এটা কোন ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয়। তবে কিছু যঈফ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত।
(৩) ইমাম ও মুক্তাদীগণ সম্মিালিত ভাবে দো‘আ করা। এটা না কোন ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত, না কোন যঈফ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। (৪) ফরয ছালাতের পর সর্বদা দলবদ্ধভাবে হাত উঠিয়ে প্রার্থনা করার কোন প্রমাণ উজ্জ্বল শরী‘আতে নেই। না ছাহাবী ও তাবেঈদের আমল দ্বারা প্রমাণিত, না হাদীছ সমূহ দ্বারা ছহীহ হৌক অথবা যঈফ হৌক অথবা জাল হঊক। আর না ফিক্বহ এর কিতাবের কোন পাতায় লিখা আছে। এ দো‘আ অবশ্যই বিদ‘আত (আহকামে দো‘আ ২১ পৃঃ)।
(১৬) পাকিস্তানের বিখ্যাত মুফতী আল্লামা রশীদ আহমাদ বলেন, রাসূল (ছাঃ) প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত পাঁচবার প্রকাশ্যে জামা‘আত সহকারে পড়লেন। যদি রাসূল (ছাঃ) কখনো সম্মিলিতভাবে মুক্তাদীগণকে নিয়ে মুনাজাত করতেন তাহ’লে নিশ্চয়ই একজন ছাহাবী হ’লেও তা বর্ণনা করতেন। কিন্তু এতগুলি হাদীছের মধ্যে একটি হাদীছও এ মুনাজাত সম্পর্কে পাওয়া যায়নি। তারপর কিছু¶ণের জন্য মুস্তাহাব মানলেও বর্তমানে যেরূপ গুর“ত্ব দিয়ে করা হচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে বিদ‘আত (ইহছানুল ফাতাওয়া, ৩ খন্ড, পৃঃ ৬৮)।
(১৭) জামা‘আতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা মওদূদী বলেন, এতে সন্দেহ নেই যে, বর্তমানে জামা‘আতে ছালাত আদায় করার পর ইমাম ও মুক্তাদীগণ মিলে যে নিয়মে দো‘আ করেন, এ নিয়ম রাসূল (ছাঃ)-এর যামানায় প্রচলিত ছিল না। একারণে বহু সংখ্যক আলেম এ নিয়মকে বিদ‘আত বলে আখ্যায়িত করেছেন (রাসাইল ও মাসাইল, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৫৫)।
(১৮) মাসিক মঈনুল ইসলাম পত্রিকার উত্তর : জামা‘আতে ফরয ছালাতের ইমাম মুক্তাদী সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা বিদ‘আত ও মাকরূহে তাহরীমি। কেননা ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে তাবেঈনদের কেউ যে কাজ শরী‘আত মনে করে আমল করেছেন এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তা নিশ্চয়ই মাকরূহ ও বিদ‘আত (মাসিক মুঈনুল ইসলাম, সফর সংখ্যা ১৪১৩ হিঃ)। প্রকাশ থাকে যে, কোন কোন আলেম ফরয ছালাতে হাত উঠিয়ে দো‘আ করার প্রমাণে কিছু পুস্তক লিখলেও প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি বিতর্কিত নয়। সিন্ধাš— হীনতার ফলে অথবা স্বার্থান্বেষী হয়ে বিষয়টিকে বিতর্কিত করা হচ্ছে। কারণ এ কথা সর্বজন বিদিত যে, রাসূল (ছাঃ), ছাহাবী ও তাবেঈগণ ইমাম-মুক্তাদী মিলে হাত উঠিয়ে দো‘আ করেননি এবং পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় আলেমগণ করেননি এবং বর্তমানেও করেন না। কাজেই উজ্জ্বল শরী‘আতে এটি স্পষ্ট বিদ‘আত।
0 Comments: