(১) আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, যখন কোন বান্দা প্রত্যেক ছালাতের পর দু’হাত প্রশস্ত করে অতঃপর বলে, হে আমার মা‘বূদ এবং ইবরাহীম, ইসহাক, ইয়া‘কূব (আঃ)-এর মা‘বূদ এবং জিবরীল, মীকাইল ও ইসরাফীল (আঃ)-এর মা‘বূদ! তোমার কাছে আমি চাচ্ছি, তুমি আমার প্রার্থনা কবুল কর। আমি বিপদাগামী, তুমি আমাকে আমার দ্বীনের উপর রক্ষা কর। তুমি আমার উপর রহমত বর্ষণ কর। আমি অপরাধী, তুমি আমার দরিদ্রতা দূর কর। আমি শক্তভাবে তোমাকে গ্রহণ করি। তখন আল্লাহর উপর হক্ব হয়ে যায় তার খালি হাত দু’খানা ফেরত না দেওয়া’ (ইবনুস সুন্নী, ‘আমালুল ইয়াউম ওয়াল লাইলে’, ৪৯ পৃঃ, হাদীছটি যঈফ। হাদীছটির সনদে আব্দুল আযীয ইবনু আব্দুর রহমান ও খায়ীফ নামে দু’জন দুর্বল রাবী রয়েছে)।
(২) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একদা রাসূল (ছাঃ) সালাম ফিরানোর পর ক্বিবলামুখী হয়ে দু’হাত উঠালেন এবং বললেন, হে আল্লাহ! ওয়ালীদ ইবনু ওয়ালীদকে পরিত্রাণ দাও। আইয়াশ, ইবনু আবী রবী‘আহ, সালাম ইবনু হিশাম এবং দুর্বল মুসলমানদের পরিত্রাণ দাও। যারা কোন কৌশল জানে না। যারা কাফেরদের হাত হ’তে বাঁচার কোন পথ পায় না’ (ইবনু কাছীর, ২য় খন্ড, সূরা নিসা ৯৭নং আয়াতের আলোচনা দ্রঃ)। হাদীছটি যঈফ (তাহযীব, ৭ম খন্ড, পৃঃ ৩২৩)। আলোচ্য হাদীছে আলী ইবনু যায়েদ ইবনে জাদআন যঈফ রাবী (তাক্বরীব, ২য় খন্ড, পৃঃ ৩৭)। আলোচ্য হাদীছটি ছহীহ বুখারীতে বর্ণিত হাদীছের বিরোধী। আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত বুখারীর হাদীছে ছালাতের মধ্যে রূকূর পর দো‘আ করার কথা রয়েছে। অথচ এই দুর্বল হাদীছে সালামের পরের কথা রয়েছে। বুখারীর হাদীছে হাত তোলার কথা নেই। কিন্তু এ হাদীছে হাত তোলার কথা বলা হয়েছে। অথচ ঘটনা একটিই এবং দো‘আ হ’ল দো‘আয়ে কুনূত। অতএব ছালাতের পর দলবদ্ধভাবে দো‘আর প্রমাণে পেশ করা শরী‘আত বিকৃত করার শামিল।
(৩) ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ছালাত দু’দু’রাক‘আত এবং প্রত্যেক দু’রাক‘আতেই তাশাহহুদ, ভয়, বিনয় ও দীনতার ভাব থাকবে। অতঃপর তুমি ক্বিবলামুখী হয়ে তোমার দু’হাতকে তোমার মুখের সামনে উঠাবে এবং বলবে, হে আমার প্রতিপালক! হে আমার প্রতিপালক! যে এরূপ করবে না তার ছালাত অসম্পূর্ণ’ (তিরমিযী, মিশকাত, পৃঃ ৭৭)। হাদীছটি যঈফ। আব্দুল্লাহ ইবনু নাফে‘ ইবনিল আময়া যঈফ রাবী (তাক্বরীব, ১ম খন্ড, পৃঃ ৪৫৬)। হাদীছে নফল ছালাতের কথা বলা হয়েছে এবং তা এককভাবে।
(৪) খাল্লাদ ইবনু সায়েব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) যখন দো‘আ করতেন, তখন তার দু’হাত মুখের সামনে উঠাতেন’ (মাযমাউয যাওয়ায়েদ, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৬৯)। হাদীছটি যঈফ। হাফস ইবনু হাশেম ইবনে উতবা যঈফ রাবী (তাক্বরীব, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৬৯)।
(৫) আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা হাতের পেট দ্বারা চাও, পিঠ দ্বারা চেয়ো না। অতঃপর তোমরা যখন দো‘আ শেষ কর, তখন তোমাদের হাত দ্বারা চেহারা মুছে নাও’ (আবুদাঊদ, মিশকাত, পৃঃ ১৯৫)। হাদীছটি যঈফ (আউনুল মা‘বূদ, ১ম খন্ড, পৃঃ ৩৬০)। নাছির“দ্দীন আলবানী (রহঃ) বলেন, হাদীছটিতে ছালেহ ইবনু হাসান নামক রাবী যঈফ এবং হাদীছের শেষে চেহারা মুছে নেওয়ার অংশটুকু অপরিচিত। এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি (সিলসিলা আহাদীছিছ ছহীহাহ, ২য় খন্ড, পৃঃ ১৪৬)। প্রকাশ থাকে যে, হাত তুলে দো‘আ করার পর হাত মুখে মোছার প্রমাণে কোন ছহীহ হাদীছ নেই। বি¯—ারিত দ্রঃ ইরওয়াউল গালীল, ২/১৭৮-১৮২, হা/৪৩৩ ও ৪৩৪-এর আলোচনা, তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/২২৫৫-এর টীকা নং ৪।
(৬) সায়েব ইবনু ইয়াযীদ তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল (ছাঃ) যখন দো‘আ করতেন তখন দু’হাত উঠাতেন এবং দু’হাত দ্বারা চেহারা মুছে নিতেন’ (আবুদাঊদ, হা/১৪৯২)। হাদীছটি যঈফ। আলোচ্য হাদীছে আব্দুল্লাহ ইবনু লাহইয়াহ নামক রাবী যঈফ (আউনুল মা‘বূদ, ১ম খন্ড, পৃঃ ৩৬০; তাক্বরীব, ১ম খন্ড, পৃঃ ৪৪৪)।
(৭) আসওয়াদ আমেরী তার পিতা হ’তে বর্ণনা করেন, তার পিতা বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে ফজরের ছালাত আদায় করেছি। যখন তিনি সালাম ফিরালেন এবং ঘুরলেন তখন হাত উঠিয়ে দো‘আ করলেন’ (ইবনে আবী শায়বা, ১ম খন্ড, পৃঃ ৩৩৭)। প্রকাশ থাকে যে, ১*য \ঘ ঘ ূর. ‘রাসূল (ছাঃ) তাঁর দু’হাত উঠালেন এবং দো‘আ করলেন’ এ অংশটুকু মূল হাদীছে নেই। মিয়াঁ নাযীর হুসাইন এবং আল্লামা মুবারকপুরী (রহঃ) হয়তোবা তদš— না করে তাঁদের কিতাবে লিখেছেন। তাই এখনও যারা বক্তব্য বা লেখনীর মাধ্যমে এ হাদীছ প্রচার করতে চান, তাদেরকে অবশ্যই হাদীছের মূল কিতাব দেখলে পরিত্যাগ করতে হবে। অন্যথা তারা হবেন নবীর উপর মিথ্যারোপকারী এবং মিথ্যা প্রচারকারী, যাদের পরিণতি ভয়াবহ (মুসলিম, মিশকাত, হা/১৯৮, ১৯৯)।
(৮) আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের একজন লোককে ছালাত শেষ হওয়ার পূর্বে হাত তুলে দো‘আ করতে দেখলেন। যখন তিনি দো‘আ শেষ করলেন, তখন আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের তাকে বললেন, রাসূল (ছাঃ) ছালাত শেষ না করলে হাত তুলে দো‘আ করতেন না (মাজমাউয যাওয়ায়েদ, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৬৯)। হাদীছটি যঈফ, মুনকার, ছহীহ হাদীছের বিরোধী। ছহীহ হাদীছে ছালাতের মধ্যে র“কূর পর কুনূতে নাযেলা পড়ার সময় হাত তোলার কথা আছে (আহমাদ, তাবারানী, সনদ ছহীহ, ইরওয়াউল গালীল, ২/১৮১, হা/৮৩৮-এর আলোচনা দ্রঃ)। তবে ছালাতের পর হাত তোলার কোন ছহীহ হাদীছ নেই।
(৯) ‘আবু নুঈম (রাঃ) বলেন, আমি ইবনু ওমর ও ইবনু যুবায়ের (রাঃ)-কে তাদের দু’হাতের তালু মুখের সামনে করে দো‘আ করতে দেখেছি’ (আদাবুল মুফরাদ, তাহক্বীক্ব হা/৬০৯, পৃঃ ২০৮, ‘দো‘আয় হাত তোলা’ অনুচ্ছেদ)। অত্র হাদীছে মুহাম্মাদ ইবনু ফোলাইহ এবং তার পিতা দু’জন যঈফ রাবী (আদাবুল মুফরাদ, পৃঃ ২০৮)।
(১০) আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, ‘যখন আদম সš—ানের কোন দল একত্রিত হয়ে কেউ কেউ দো‘আ করে, আর অন্যরা আমীন বলে। আল্লাহ তাদের দো‘আ কবুল করেন’ (মু¯—াদরাক হাকেম, আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, ১ম খন্ড, পৃঃ ৯০)। হাদীছটি যঈফ। ইবনু লাহইয়াহ নামে রাবী দুর্বল (তাক্বরীবুত তাহযীব, পৃঃ ৩১৯, রাবী নং ৩৫৬৩)।
(১১) একদা আলী হাজরামী ছাহাবী লোকদের নিয়ে ছালাত আদায় করেন। ছালাত শেষে হাটু গেড়ে বসেন, লোকেরাও হাটু গেড়ে বসে। তিনি হাত তুলে দো‘আ করেন এবং লোকেরা তার সাথে ছিল (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ, ৩য় জিলদ, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃঃ ৩৩২)। এ ঘটনা ইতিহাস দ্বারা প্রমাণিত। কাজেই তা দলীল যোগ্য নয়। প্রকাশ থাকে যে, হাদীছের সনদ থাকা সত্তে¡ও কোন রাবী যঈফ হ’লে তার হাদীছ গ্রহণ করা হয় না। আর ইতিহাসের তো কোন সনদ থাকে না। তাহ’লে তা দলীলযোগ্য হয় কি করে? এ বিবরণকে হাদীছ বললে ছাহাবীর উপর মিথ্যা আরোপ করা হবে।
(১২) হুসাইন ইবনু ওয়াহওয়াহ হ’তে বর্ণিত, ত্বালহা ইবনু বারায়া মৃত্যুবরণ করলে তাকে রাতে দাফন করা হয়। সকালে রাসূল (ছাঃ)-কে সংবাদ দেওয়া হ’লে রাসূল (ছাঃ) এসে কবরের পার্শ্বে দাঁড়ান, লোকেরা তাঁর সাথে সারিবদ্ধ হয়। অতঃপর তিনি দু’হাত তোলেন এবং বলেন, হে আল্লাহ! ত্বালহা তোমার উপর সন্তুষ্ট ছিল, তুমি তার উপর রহমত বর্ষণ কর’ (তাবারানী, মাজমাউয যাওয়ায়েদ)। প্রকাশ থাকে যে, হাদীছটি যঈফ, মুনকার ও ছহীহ হাদীছের বিরোধী। ছহীহ হাদীছে কবরের পাশে জানাযা পড়ার কথা রয়েছে। মূল গ্রন্থে হাত তোলার কথা নেই (বুখারী, ১ম খন্ড, ‘জানাযা’ অধ্যায়)।
(১৩) ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যখন তুমি আল্লাহর নিকটে দো‘আ করবে, তখন তোমার দু’হাতের পেট দ্বারা কর। দু’হাতের পিঠ দ্বারা দো‘আ কর না। অতঃপর যখন দো‘আ শেষ করবে তখন দু’হাত দ্বারা চেহারা মুছে নাও (ইবনু মাজাহ, পৃঃ ৮৩)। হাদীছটি যঈফ। উল্লেখ্য যে, মুখে হাত মোছার প্রমাণে কোন ছহীহ হাদীছ নেই।
(১৪) জাবের ইবনু আবদিল্লাহ (রাঃ) বলেন, তোফায়েল (রাঃ)-এর গোত্রের জনৈক ব্যক্তি তার সাথে হিজরত করেন এবং অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে সে তার কাঁধের রগ কেটে ফেলে এবং মৃত্যুবরণ করে। তোফায়েল (রাঃ) একদা স্বপ্নে তাকে জিজ্ঞেস করেন, আল্লাহ আপনার সাথে কিরূপ আচরণ করেছেন? তিনি বললেন, নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট হিজরত করার কারণে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তোফায়েল (রাঃ) বললেন, আপনার দু’হাতের খবর কী? তিনি বললেন, আমাকে বলা হয়েছে, তুমি যে অংশ নিজে নষ্ট করেছ, তা আমি কখনো ঠিক করব না। এ স্বপ্ন তোফায়েল (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট বর্ণনা করলে তিনি তার জন্য দু’হাত তুলে ক্ষমা চাইলেন (আদাবুল মুফরাদ, ২/৭০ পৃঃ)। হাদীছটি যঈফ (ছহীহ আদাবুল মুফরাদ হা/৬১৪, পৃঃ ২১০)। আনাস (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে দু’হাতের পেট ও পিঠ দ্বারা দো‘আ করতে দেখেছি (আবুদাঊদ)। হাদীছ যঈফ (আউনুল মা‘বূদ, পৃঃ ২৫২)।
প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত যঈফ হাদীছ সমূহের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে বুঝা যায় যে, কোন কোন সময় ছালাতের পর এককভাবে হাত তুলে দো‘আ করা যায়। কিন্তু যঈফ হওয়ার কারণে হাদীছগুলি রাসূল (ছাঃ)-এর কি-না, তা স্পষ্ট নয়। সেকারণ এর উপর আমল করা থেকে বিরত থাকা যরূরী। মাওলানা আব্দুর রহীম বলেন, কেবলমাত্র ছহীহ হাদীছ ব্যতীত অন্য কোন হাদীছ গ্রহণ করা যাবে না। এ কথায় হাদীছের সকল ইমাম একমত ও দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ (হাদীস সংকলনের ইতিহাস, পৃঃ ৪৪৫)। সিরিয়ার মুজাদ্দেদ আল্লামা জামালুদ্দীন কাসেমী বলেন, ইমাম বুখারী, মুসলিম, ইয়াহইয়া, ইবনু মুঈন, ইবনুল আরাবী, ইবনু হাযম ও ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, ফযীলত কিংবা আহকাম কোন ব্যাপারেই যঈফ হাদীছ আমলযোগ্য নয় (ক্বাওয়াইদুত তাওহীদ, পৃঃ ৯৫)।
0 Comments: